বিশ্ব ইজতেমায় লাখো মুসল্লির আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত টঙ্গীর তুরাগ তীর। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবিরাম চলছে বিভিন্ন ভাষায় কোরআন-হাদিসের বয়ান। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা আলেমরা বিভিন্ন বিষয়ে বয়ান করছেন।
বয়ানে বলেন, যারা দুনিয়াতে দ্বীনের ওপর চলবে, ঈমানকে সুন্দর ও মজবুত করবে, আমলকে সুন্দর করবে, আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে কামিয়াবি দান করবেন। ঈমান ও আমল ছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতে কামিয়াব হওয়া যাবে না। ঈমান আমলের পাশাপাশি নামাজকে সুন্দর করতে হবে। আল্লাহকে পেতে হলে নামাজ পড়তে হবে। জাহান্নাম থেকে বাঁচতে এবং জান্নাত লাভের মাধ্যম হলো নামাজ। দিনে ৫ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা হয়। যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ খুশু খুযুর সঙ্গে আদায় করবে আল্লাহ তাকে নাজাত দেবেন। পরকালে শান্তি পেতে চাইলে ভালো আমল করতে হবে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মনোনিবেশ করে ঈমান, আখলাক ও দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ের বয়ান শোনেন।
প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন আজ শনিবার বাদ ফজর থেকে ইজতেমা মাঠে লাখ-লাখ মুসল্লির উদ্দেশ্যে চলছে পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান।
আগামীকাল রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১ টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে ইজতেমা আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। এর আগে হেদায়েতি বয়ান করা হবে। তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বীদের পরামর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মোনাজাতে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হবে। আখেরি মোনাজাতে প্রায় ২৫-৩০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নিবেন বলে আয়োজকদের ধারণা। ইজতেমার প্রথম পর্বে শিল্প নগরী টঙ্গী ইতোমধ্যেই ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে।
আজ সকালে টঙ্গী শহর ও ইজতেমাস্থলের আশপাশ এলাকা যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখ-লাখ মুসল্লির পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। এদিনও টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। সেটি আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে।
যারা বয়ান করছেন :
সকালে বয়ানে ওলামায়ে কেরাম বলেন, দাওয়াতের মেহনত হলো নবুওয়াতি মেহনত। এ মেহনত খুলুসিয়াত ও আজমতের সঙ্গে যারা করবে তাদের যে কোনো আমলের ফজিলত বহুগুণ বেড়ে যায়। বয়ানে বলা হয়, পরকালের চিরস্থায়ী সুখ শান্তির জন্য আমাদের প্রত্যেককে দুনিয়াতে জীবিত থাকা অবস্থায় দ্বীনের দাওয়াতের কাজে জানমাল দিয়ে মেহনত করতে হবে। ঈমান আমলের মেহনত ছাড়া কেউ হাশরের ময়দানে কামিয়াব হতে পারবে না। ইজতেমায় মূল বয়ান উর্দুতে হলেও অংশ নেয়া বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসল্লিদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনের শুরুতে বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা খোরশিদুল হক। সকাল ১০টায় বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা ইবরাহিম দেওলা, মাদরাসা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বয়ান করবেন পাকিস্তানের মাওলানা খোরশিদ, আরব জামাতের জন্য বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা আহমদ লাট, বোবা ও বধিরদের জন্য বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা সানোয়ার, বিদেশি জামাতের মুসল্লিদের জন্য ইংরেজিতে বয়ান করবেন পাকিস্তানের মাওলানা ইফতার জামান। বাদ জোহর বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা ফারুক। বাদ আসর বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা যুহাইরুল হাসান এবং অনুবাদ করবেন মাওলানা যোবায়ের।
ইজতেমায় আইনশৃঙ্খলা: ইজতেমাকে কেন্দ্র করে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলাসহ সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ১০ হাজার পুলিশ কাজ করছে। আশা করি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না। নিরাপদে সকলে যেন ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারে সে বিষয়ে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি।
ভ্রাম্যমাণ আদালত: বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে মুসল্লিদের নিরাপদ অবস্থান ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এসব অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইজতেমায় অতিরিক্ত দামে কম্বল বিক্রি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার বিক্রিসহ বিভিন্ন অভিযোগে গতকাল ১৪ ব্যবসায়ী বিভিন্ন অংকের টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
বিশ্ব ইজতেমায় ইবনে সিনার ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প: টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের ফ্রি চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মেডিক্যাল ক্যাম্প চালু করেছে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ। ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্সটাইল মিলস-সংলগ্ন নির্ধারিত স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এলাকায় ইবনে সিনার এ মেডিক্যাল ক্যাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি।
র্যাবের চিকিৎসা কেন্দ্র : বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ইজতেমা মাঠ সংলগ্ন এলাকায় চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। চিকিৎসা কেন্দ্রে মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন প্রকার ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। মুসল্লিদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাসহ গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার জন্য পোর্টেবল অক্সিজেন, নেবুলাইজেশন ও অন্যান্য চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এছাড়াও ইজতেমায় স্থাপিত মেডিকেল সেন্টারের মোবাইল নম্বরে (০১৭৭-৭৭২০০৪৫) যোগাযোগ করা জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
চিকিৎসা সেবা স্বাস্থ্য বিভাগ: বিশ্ব ইজতেমায় আগত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা, ওষুধপত্র সরবরাহে স্বাস্থ্য বিভাগের নেতৃত্বে অস্থায়ী ৬টি কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রয়োজনে জরুরি অ্যাম্বুলেন্সের বিশেষ ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। অস্থায়ী ৬টি কেন্দ্রগুলো হলো হোন্ডাগেট ১টি, বাটা গেট ১টি, মন্নুগেট ১টি, তুরাগ নদীর পশ্চিম তীরে ২টি এবং প্রতি বছরের ন্যায় বিদেশি মেহমানদের জন্য ১টিসহ মোট ৬টি অস্থায়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেবা দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালকে রাখা হয়েছে। এদিকে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে তুরাগ নদীর উত্তর পাশে এবং রেড ক্রিসেন্টের সহায়তায় দক্ষিণ পাশে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
ইজতেমায় ৪ মুসল্লির মৃত্যু : ইজতেমা ময়দানে বার্ধক্যজনিত কারণে আরও দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তাদের একজন হাবিবুল্লাহ হবি (৬৭)। তিনি ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। অন্যজন ঢাকা যাত্রাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আক্কাস আলী (৫০)। শুক্রবার বিকেলে ময়দানের ৪২১ নং হালকায় আক্কাস আলী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
জানাযা শেষে তাদের মরদেহ গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে চার মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন ইজতেমা আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বকারী মুফতি জহির ইবনে মুসলিম।