পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন যুক্তরাজ্যকে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১ লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। ঢাকার ওপর থেকে অন্যায্য বোঝা কমাতে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের বিশ্বনেতা ব্রিটেনকে এ প্রস্তাব দেন তিনি।
আজ প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪-২৫ জুন কিগালিতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিজাবেথ ট্রুসের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোমেন এ প্রস্তাব করেন।
একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবিলম্বে প্রর্ত্যাবাসনের জন্যে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
কারণ মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গার ভার বাংলাদেশ আর বইতে পারছে না।
মোমেন ট্রুসের কাছে দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট এবং মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকায় সেদেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের অচলাবস্থার কথা তুলে ধরেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি ৭০ ও ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ এবং পরবর্তীকালে ঢাকার সাথে সমঝোতা ও চুক্তির মাধ্যমে মিয়ানমার কর্তৃক তাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক তথ্যের উল্লেখ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ওই সময়ে পশ্চিমাদের অবরোধের শিকার হয়ে মিয়ানমার এ পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু, বর্তমানে তা ঘটছে না। বরং আইসিজেতে বিচারের রায় এবং রোহিঙ্গাদের ওপর তাদের নিপীড়নের জীবন্ত প্রমাণ সত্ত্বেও ব্রিটেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ মিয়ানমারে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।
মোমেন বলেন, যুক্তরাজ্য গত তিন বছরে মিয়ানমারে আড়াইশো কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এবং ৫০ কোটিরও বেশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করেছে, তাদের রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করা প্রয়োজন।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উদার আতিথেয়তার জন্যে বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, যুক্তরাজ্য বিষয়টি দেখতে পারে, কিন্তু, এটির সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে তাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তন।
মিয়ানমারে বর্তমানের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্রিটিশ সরকারের উদ্বেগের কথা তুলে ধরে ট্রুস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুক্তরাজ্যের অব্যাহত অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
এছাড়া, ব্রিটিশ এই মন্ত্রী আশ্বস্ত করেন, আসিয়ান ও জি ৭ দেশগুলোকে সাথে নিয়ে যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াবে।
উভয়ের এটি প্রথম আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। বৈঠকে উভয়মন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দু’দেশের ঐতিহাসিক ও মূল্যবোধ ভিত্তিক সম্পর্কের বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করেন।
তারা ভারত মহাসাগরে অভিন্ন নিরাপত্তা স্বার্থ এগিয়ে নেয়া, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব জোরদার এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সহযোগিতা বাড়ানোসহ উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে একটি উচ্চাভিলাষী এবং নিরন্তর সম্প্রসারিত বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য কৌশলগত অংশীদারিত্বের সারণী ধরে বেক্স্রিট পরবর্তী বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী যৌথভাবে উদযাপনে সম্মত হয়।
মোমেন ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়িক ভিসা কম দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরলে ব্রিটিশ মন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার্থীর কম সংখ্যার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিবছর অন্তত ৭ থেকে ৮ হাজার উচ্চশিক্ষার্থী যাতে যুক্তরাজ্যে যেতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়িক ভিসা সুবিধা ঢাকাকে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানান।
ব্রিটেন ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উভয়মন্ত্রী দুদেশের রাজধানীতে যৌথভাবে গ্লোবাল গার্লস এডুকেশন সামিট, ক্লাইমেট লিডার্স ডায়ালগ এবং রোহিঙ্গা সম্মেলন আয়োজনে দুদেশের পররাষ্ট্রদপ্তরের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান।
উভয়ে বর্তমান ইউক্রেন পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বিশ্বখাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহসহ আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধারে নিবিড়ভাবে কাজ করতে সম্মত হন।
মোমেন বলেন, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে বাংলাদেশ গভীরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।
যুক্তরাজ্যের সাথে বেক্সিটোত্তর বাণিজ্যিক সম্পর্কে বাংলাদেশ বৃহত্তম বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদার। মোমেন বর্তমান জীবন যাত্রার ব্যয়, ব্রিটেনের খুচরা ব্যবসায়ীদের মূল্য পরিশোধ না করা এবং মহামারির পর বাতিলকরণের কারণে পোশাক শিল্পের ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য ২০২৯ সাল পর্যন্ত শূন্য শুল্কের যে বিশেষ জিসএসপি সুবিধা দিয়েছে তা আরো বাড়ানোর অনুরোধ জানান।
দুদেশের মন্ত্রী বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আলোচনার মাধ্যমে উভয়দেশের বর্ধিত বাণিজ্য অংশীদারিত্ব ও এবং একটি ভবিষ্যত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অন্বেষণ করার বিষয়ে আবারো একমত হন।
ড. মোমেন বিশেষ করে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক এ বছরে যত দ্রুত সম্ভব ট্রুসকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
বৈঠককালে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম উপস্থিত ছিলেন।