অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের গৃহভিত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত নারী কর্মীরা দেশের অর্থনীততে বিরাট অবদান রাখছে। গ্লোবাল গার্মেন্টস সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে সংযুক্ত বাংলাদেশে গৃহভিত্তিক প্রায় ২০ লাখ উদ্যোক্তার মধ্যে অধিকাংশই নারী কর্মী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে গৃহভিত্তিক প্রায় ২০ লাখ কর্মীর মধ্যে প্রায় ১৮ লাখই নারী কর্মী। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা (ওশি) ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রিপন চৌধুরী জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গৃহকর্মে নিয়োজিতরা শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি চায়। কিন্তু তারা তা পাচ্ছেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১৮ লাখ গৃহভিক্তিক নারী কর্মী বিরাট অবদান রাখছে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার গৃহভিত্তিক শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার উপর কি প্রভাব ফেলেছে তা নির্ণয় করতে হোমনেট সাউথ এশিয়া ২০২০ ও ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় নারী গৃহভিত্তিক শ্রমিকদের ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব শীর্ষক এক গবেষণা পরিচালনা করে। গত ২৬ জানুয়ারি এই গবেষণা প্রতিবেদনটি ঢাকায় একটি সেমিনারে উপস্থাপন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় গৃহভিত্তিক কর্মী বা শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত সংস্থা হোমনেট সাউথ এশিয়ার সদস্য লেবার অ্যাট ইনফরমাল ইকোনমি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। হোমনেট সাউথ এশিয়ার সদস্য হিসেবে লেবার অ্যাট ইনফরমাল ইকোনমি (এলআইই) এবং কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ) এই গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত ছিল বলে ওশি ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আসাদ উদ্দিন জানিয়েছেন। গবেষণায় উঠে আসে করোনাভাইরাসের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় গৃহভিত্তিক কর্মীদের কর্মসংস্থান এবং উপার্জন হ্রাস পায়, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার সংকট দেখা দেয়, সামাজিক সুরক্ষার দুর্বলতা, ত্রাণ কার্যক্রমের অপ্রতুলতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয় গৃহভিত্তিক নারী কর্মীরা। দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান ছাড়া সাতটি দেশের বারোটি এলাকার (ঢাকা, থিম্পু, আহমেদাবাদ, মুম্বাই, ফুলিয়া, তিরুপুর, মালে, কাঠমান্ডু, করাচি, লাহোর, কলম্বো এবং ক্যান্ডি এলাকার ৪০০ জনের বেশি গৃহভিত্তিক কর্মীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণায় বাংলাদেশের ঢাকা শহরের ৬০ জন গৃহভিত্তিক শ্রমিকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যাদের বেশির ভাগ গার্মেন্টস সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে যুক্ত। এতে বলা হয়, করোনার সময় বাংলাদেশের যেসব কর্মী বা শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়েছিলেন তা ধীরগতিতে পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছিল। এতে গৃহভিত্তিক কর্মী বা শ্রমিকদের আয় হ্রাস পেয়ে শতকরা ৪১ ভাগ হয়েছে। ৯৪ শতাংশ গৃহভিত্তিক কর্মী জানান, তাদের কাছে কাজের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে এবং প্রায় ৭৮ শতাংশ কর্মী জানান, তাদের পণ্যের দাম আগের বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। গৃহভিত্তিক নারী শ্রমিকরা দরজীগিরি, সেলাই, বোতাম লাগানো এবং এমব্রয়ডারি কাজে দক্ষ।
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গৌতম কুমার বাসসকে বলেন, গৃহকর্মে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তারা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। সরকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রমিক ও উদ্যোক্তা এক নয়। মালিকের নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে কাজ করলে তাকে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায়। তাদের সংগঠন করারও অধিকার থাকবে। শ্রম অধিদপ্তর কর্তৃক বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬, বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ এবং শ্রম সংক্রান্ত সকল আইন ও বিধি অনুসরণপূর্বক দেশের শ্রম খাতে সুষ্ঠু শ্রমসেবা প্রদান করা হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নকল্পে ১৪ হাজার ৪৯৪ জনকে প্রশিক্ষণ, ৬২ হাজার ৯৯৪ জনকে বিনামূল্যে পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ১৯১ জনকে বিনোদনমূলক সেবা প্রদান করা হয়।
তিনি আরো বলেন, শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় খাতে নিয়োজিত শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ তহবিল থেকে কোন শ্রমিক দুর্ঘটনার কারণে দৈহিক ও মানসিকভাবে স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে, মৃত্যুবরণ করলে, মৃতদেহের পরিবহন ও সৎকার, দূরারোগ্য চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মহিলা শ্রমিকের মাতৃত্ব কল্যাণ, বিশেষ দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ আর্থিক প্রণোদনাসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। এ তহবিল থেকে নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার ৬৪০ জন শ্রমিককে প্রায় ৩৯ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা, শিক্ষার জন্য ১ হাজার ২৭৭ জন শ্রমিকের সন্তানকে প্রায় ৪ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা, ৬৭৫ জন মৃত শ্রমিকের পরিবারকে প্রায় ৫ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা সর্বমোট ১২ হাজার ৫৯২ জনকে প্রায় ৪৯ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। দেশের গরিব ও দুঃস্থ শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারের কল্যাণ সাধনে এ তহবিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বেসরকারি সংস্থা কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওরের (কাপ) নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবেকা সানইয়াত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় নারী গৃহভিত্তিক শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীততে রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এই কর্মীদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গৃহভিত্তিক কর্মী বা শ্রমিকের কার্যক্রম এখনো অদৃশ্য এবং তারা এখনো স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশ শ্রম আইনে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃত না থাকায় তারা শোভন কর্মপরিবেশ এবং সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। এছাড়াও, তারা পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরীসহ শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই, এই শ্রমিকদের অধিকার ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সবার আগে দরকার শ্রমিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি এবং যুগপযোগী আইন প্রণয়ন।
তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিমাংশু মিত্র বলেন, স্থানীয় এবং বৈশ্বিক গার্মেন্টস সাপ্লাই চেইনে সমস্যার কারণে এই শ্রমিকদের কাজ এবং উপার্জন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। দীর্ঘ দিনব্যাপী বৈশ্বিক চাহিদার অবনতি এবং বাজার কার্যক্রম বা সরবরাহ বন্ধ এবং চলাচল ও কার্যক্রমে বিধিনিষেধ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ২০২০ সালের লকডাউনের সময় ঢাকার ৯০ শতাংশ গৃহভিত্তিক শ্রমিকের (উত্তরদাতা) কোনো কাজ ছিল না। উত্তরদাতাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ যা ২০২০ সালে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন কাজে জড়িত ছিলেন, সেখানে ২০২১ সালে তা বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশে সম্প্রসারিত হয়েছে। টিকাদানের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে টিকার ঘাটতি, নিবন্ধন সমস্যা, এবং অব্যবস্থাপনার কারণে টিকাদানের অগ্রগতি কিছুটা ব্যাহত হয়।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় গৃহভিত্তিক শ্রমিকদের কর্মসংস্থান এবং উপার্জন হ্রাস পায়, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার সংকট দেখা দেয়, সামাজিক সুরক্ষার দুর্বলতা, ত্রাণ কার্যক্রমের অপ্রতুলতাসহ বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয় গৃহভিত্তিক নারী শ্রমিকরা। স্থানীয় এবং বৈশ্বিক গার্মেন্টস সাপ্লাই চেইনে সমস্যার কারণে এই শ্রমিকদের কাজ এবং উপার্জন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বৈশ্বিক চাহিদার অবনতি এবং বাজার কার্যক্রম বা সরবরাহ বন্ধ এবং চলাচল ও কার্যক্রমে বিধিনিষেধ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রগ্রস্ত করেছে। লকডাউনের সময় ঢাকার ৯০ শতাংশ গৃহভিত্তিক শ্রমিকের কোনো কাজ ছিল না। ৯৪ শতাংশ গৃহভিত্তিক শ্রমিক জানান, তাদের কাছে কাজের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে এবং প্রায় ৭৮শতাংশ শ্রমিক জানান, তাদের পণ্যের দাম আগের বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে।