বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় দেশব্যাপী লকডাউন দেয়া হয়েছিল। এসময় হাসপাতালগুলোতেও ছিল প্রচন্ড ভিড়। সেখানে রোগীর চাপের তুলনায় চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল। তখন হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারী সেবা অতটা সহজলভ্য ছিল না। এছাড়া, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকিতো রয়েছেই।
জেলার সদর উপজেলার মৌকরণ গ্রামের বাসিন্দা রুমা সন্তুষ্টির সুরে জানালেন, সব শুনে ডাক্তার অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে আমার মা সম্ভবত কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হননি। ফলে, তিনি তাকে জ্বরের জন্য ওষুধ লিখে দিয়ে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার পরামর্শ দিলেন।
‘ডাক্তার বললেন, আমার মা যদি আরও কোন জটিলতার মুখোমুখি হয় তাহলে যেন আবার ’৩৩৩’ এ ডায়াল করি। কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি আমাকে প্রেসক্রিপশন পাঠালেন,’ বললেন রুমা। তিনি জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে তার মায়ের অবস্থার উন্নতি হয়।
‘টেলিমেডিসিন পরিষেবা খুবই সহায়ক,’ উল্লেখ করে রুমা বলেন, প্রয়োজন হলে সবারই এই চিকিৎসা পরামর্শের সেবাটি গ্রহণ করা উচিত।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. সাফিউল ইসলামকে তার বাবাকে নিয়ে প্রায় একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার ৭০ বছর বয়সী বাবা একজন ডায়াবেটিক রোগী। তিনি দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছেন।
‘জ্বর এবং হাত-পায়ে জয়েন্টে ব্যথা। বাবার অসুস্থতা দেখে আমি সত্যিই অসহায় বোধ করছিলাম। বিষয়টা বন্ধু রবিনকে জানালাম। সে আমাকে টেলিমেডিসিন সেবা পেতে ’৩৩৩’ নম্বরে ফোন করার পরামর্শ দেয়। কারণ, কোনো হাসপাতালে সশরীরে উপস্থিত হয়ে চিকিৎসা নেয়া খুবই কঠিন ছিল,’ বলেন সাফিউল ।
হটলাইনে একজন মহিলা ডাক্তারের সাথে সংযোগ পেলেন। তাকে বাবার স্বাস্থ্যের অবস্থা বর্ণনা করলেন। ডাক্তার সমস্যা শুনলেন। তার পর বাবার জন্য কিছু ওষুধের নাম লিখতে বললেন। তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সবকিছু সঠিকভাবে করেছি। আল্লাহর রহমতে আট দিনেই বাবা অনেকটা সুস্থ হলেন।’
’৩৩৩’ হলো একটি জনসেবা হটলাইন যা ‘জাতীয় হেল্পলাইন’ নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রনালয়ের এট্আুই প্রোগ্রাম দ্বারা পরিচালিত। এর লক্ষ্য হচ্ছে জনসেবা গ্রহণের পদ্ধতি এবং সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় তথ্য প্রচার করা। এটি তৈরি করা হয়েছিল কোভিড-১৯ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাডাতে এবং বাড়িতে বসেই সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার জন্য। শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত চিকিৎসকরাই এখানে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ও সহকারী সার্জন ডাক্তার মনিরুজ্জামান খানের বলেন, ‘আমি অনেক রোগীকে টেলিমেডিসিন সেবা দিয়েছি, তাদের বেশিরভাগই ছির করোনা রোগী।’
‘একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে, আমি সরাসরি এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং সেবা দান করে মানুষকে টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করি,’ দু’বার করোনায় আক্রান্ত এই চিকিৎসক যোগ করলেন।
ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের একজন ডা. পলাশ কুমার রায় এখন রংপুর সিটি কর্পোরেশনে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তিনি বাসসকে জানান, এখন পর্যন্ত ১১,৬০০ এর অধিক মানুষকে চিকিৎসা পরামর্শ দিয়েছেন।
‘একজন ইতালীয়, যিনি বাংলাদেশে একটি প্রকল্পে কাজ করেন, তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ছিলেন। তিনি ‘৩৩৩’ হটলাইনে কল করেন। আমি তাকে চিকিৎসা সেবা দেই,’ তিনি বলেন।
ডাক্তার পলাশ উল্লেখ করেন, ‘তিনি ১৪ দিন পর আবার ফোন করলেন। ভাগ্যক্রমে, আমিই ফোন কলটি রিসিভ করেছিলাম। তার পরিচয় পেয়ে, আমি তাকে বললাম যে আমি তাকে আগের চিকিৎসা দিয়েছি। রোগি জানালেন, তিনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন।’
এটুআই এর ’টেলিমেডিসিন সেবা’র জাতীয় পরামর্শক হয়ে কাজ করছেন দিদার-ই-কিবরিয়া।
তিনি জানালেন, যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও করোনাভাইরাস মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিল, অর্থাৎ গত বছর এপ্রিলে দেশব্যাপী লকডাউন ছিল, সেই সময় কেউ এই নতুন মহামারী মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ছিল না। তখন থেকে, বিএমডিসিতে নিবন্ধিত প্রায় ৪৫০০ ডাক্তার অবসর সময়ে ফোনে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন। এজন্য যোগ্য চিকিৎসকদেরকে অবশ্য এটুআই, মুক্তপাঠ এবং টেলিমেডিসিন পরিষেবা দ্বারা বিকশিত জাতীয় ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোভিট-১৯ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স সম্পন্ন করতে হয়েছে।
এখন পর্যন্ত মোট ৪৪৭,০৭৭ জনকে এর মাধ্যমে পরিষেবা এবং পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দেশের সকল সাধারণ মানুষকে ঘরে বসে করোনা বিষয়ে সচেতনতা ও করোনা বিষয়ক চিকিৎসা পরামর্শ দিতে এটুআই এর উদ্যোগে ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় তৈরি হয় ’ডক্টর পুল অ্যাপস’।
নাগরিক সেবায় এগিয়ে আসে ৩৩৩ কলসেন্টার। এর মাধ্যমে ফ্রন্টলাইনার (সম্মুখযোদ্ধা) খ্যাত ডাক্তাররা জাতীয় সেবা প্রদানকারী ‘৩৩৩’ এর মাধ্যমে করোনাকালে জরুরী নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান শুরু করে।
তিনি বলেন, ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় নতুন এ সেবায়। প্রচুর কল আসে। লোড সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল সবাই। পাশাপাশি এর ব্যবহারে চলে ব্যাপক প্রচারণা। বর্তমানে প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ হাজার কল রিসিভ করতে পারবে এই ভাবে ৩৩৩ ইনফ্রাস্ট্রাকচার আর্কিটেকচার ডিজাইন করা হয়েছে।
এই অ্যাপসের বিশেষত্ব ছিল ৪৫০০ ডাক্তার ২৪ ঘন্টা সাধারণ মানুষের যে কোন প্রশ্নের উত্তর ও চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকে।
দিদার জানান, এটি ব্যবহার করে, প্রায় ৪৯৯,৩২০জন করোনার তথ্য পেয়েছেন। হোম কোয়ারেন্টাইনের তথ্য ৬৩৮,০৭০জন নিয়েছেন। ডাক্তাররা এসএমএসের মাধ্যমে ৩৩,২৫১ জনকে প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন।
এই সেবাটি বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ধনী-দরিদ্র সকলের চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়ার অপার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অনলাইন মেডিকেল পরামর্শে এখন তাৎক্ষণিকভাবে তারা উপকৃত হতে পারে, তা গভীর রাত হোক কিংবা হাসপাতাল থেকে যতই দূরে হোক না কেন।
‘যদি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পায়, তবে, হাসপাতালের চাপ কমবে। হাসপাতালে আসা রোগীদের উন্নত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হবে। এইভাবে, রোগীদের সন্তুষ্টিও বৃদ্ধি পাবে,’ এটুআই কর্মকর্তা আশা প্রকাশ করেন।