You are here
Home > মতামত > গাজী বেলায়েত হোসেন, বেগম পাড়া এবং আমাদের মিডিয়া

গাজী বেলায়েত হোসেন, বেগম পাড়া এবং আমাদের মিডিয়া

দুবছর আগে ঢাকার কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। সংবাদটি ছিল একজন কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীকে নিয়ে যিনি রিপোর্ট অনুযায়ী বেসিক ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা লুট করে পালিয়ে গেছেন।

আলোচিত ব্যক্তি, গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু, বেসিক ব্যাংক থেকে আদৌ ৩০০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন কিনা এটা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যাচাই না করেই প্রথমে একটি বাংলা দৈনিক এবং পরে কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক এবং অনলাইন পত্রিকা সংবাদটি প্রকাশ করে। স্পর্শকাতর এই সংবাদকে পুঁজি করে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক হইচই হয়। কানাডার বহুল আলোচিত ও সমালোচিত বেগম পাড়ার আইকন বনে যান গাজী বেলায়েত হোসেন। তার এবং তার পরিবারের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে একটি চোর পরিবার হিসাবে। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাকে সেদেশ থেকে বহিস্কারের দাবী নিয়ে রাস্তায় নেমে পরে।

এতো কিছু ঘটে গেছে এই পরিবারের উপর যে টাকার অংকটির উপর ভিত্তি করে, সেই ৩০০ কোটি টাকার কোন ঋণই আসলে তিনি বেসিক ব্যাংক থেকে নেননি, কিংবা তার নেয়া ঋণও সুদে আসলে সেই অংকের কাছাকাছি পৌছায়নি।

গাজী বেলায়েতের ধারণা কানাডায় তার এক সাবেক ব্যাবসায়িক অংশীদারের দেয়া তথ্যই সংবাদ মাধ্যমগুলো যাচাই বাছাই না করে প্রকাশ করেছে। তার উদ্দেশ্য ছিলো, দেশে ফেরার পর যাতে গাজী বেলায়েত কানাডায় ফিরতে না পারেন এবং তাদের যৌথ ব্যাবসা সেই ব্যক্তি একাই ভোগ করতে পারেন। সেই অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) সাদা কাগজে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিলো এবং দুদক তার কানাডায় ফেরার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়েছিলো। উচ্চতর আদালতের হস্তক্ষেপে পরে এই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়।

৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ সালে বাংলা দৈনিকটিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ ১২টি কোম্পানির নামে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে এসএফজি শিপিং লাইন, এস রিসোর্সের শিপিং লাইন, এস সুহী শিপিং লাইন, শিফান শিপিং লাইন, এশিয়ান শিপিং লাইন, ল্যাবস এন্টারপ্রাইজ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, ডেল্টা সিস্টেমস লিমিটেড, ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ, গ্রীন বাংলা হোল্ডিং কিয়েব ট্রেডিং এবং এম নাছিরউদ্দিন ও বাসগৃহ প্রোপাটিজ। কোম্পানিগুলো ১৭টি ব্যাংকের ২৪টি শাখা থেকে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান ও ৮ ব্যক্তির নামে ৩০০ কোটি টাকা তুলে নেয়। এর মধ্যে একাধিক শিপিং লাইনের সঙ্গে বেলায়েতের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

উপরে উল্লেখিত একটি প্রতিষ্ঠানও গাজী বেলায়েতের মালিকানাধীন নয়। তবে দৈনিকটি লিখেছে, এর মধ্যে একাধিক শিপিং লাইনের সঙ্গে বেলায়েতের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। কিন্তু গাজী বেলায়েত কিভাবে সংশ্লিষ্ট এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নেয়া ঋণের দায় কিভাবে তার উপর বর্তায় সে সম্পর্কে একটি লাইনও লেখা হয়নি।

পরে দায়িত্বশীল হিসাবে সুনাম আছে এরকম কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজী দৈনিকও এই সংবাদের ফলো আপ রিপোর্ট করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে কথা না বলে, কোন ধরণের যাচাই বাছাই ছাড়াই তারাও ৩০০ কোটি টাকা ঋণের কথা লিখেছে।

এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে গাজী বেলায়েত কানাডা থেকে জানান, তিনি বেসিক ব্যাংকের থেকে তারা মালিকানাধীন গাজী ব্রিক্স এর জন্য ২১ কোটি টাকা এবং বেলায়েত নেভিগেশনের জন্য ৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। যে দুটো প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছিলেন সেগুলো বাস্তবায়নও করেছেন এবং বেলায়েত নেভিগেশনের ৮ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে ৪ কোটি টাকা শোধও করেছেন। তবে তার দুটো ঋণই বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে নেয়া। গুলশান বা অন্য কোন শাখা থেকে তিনি কোন ঋণ নেননি।

তিনি বলেন, তার দুটো ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সম্পদ মর্টগেজ হিসাবে ব্যাংকে দেয়া আছে। তিনি জানান, গাজী ব্রিক্স এর ঋণের বিপরীতে ৩০ কোটি টাকার সম্পদ এবং বেলায়েত নেভিগেশনের ঋণের বিপরীতে ২০ কোটি টাকার জমি ও কারখানা ব্যাংকে মর্টগেজ হিসাবে দেয়া আছে।

গাজী বেলায়েত বলেন, তার এই ঋণ এখন সুদে, আসলে এবং জরিমানাসহ কত হয়েছে তিনি জানেন না। তবে আগামী এপ্রিল মাসে দেশে এসে ব্যাংকের সাথে কথা বলে তিনি এই ঋণ সমন্বয় করবেন বলে জানান।

জিজ্ঞেস করা হলে বেসিক ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গাজী বেলায়েতের মোট ঋণের পরিমাণ ৫৭ কোটি টাকা। ব্যাংকের কাছে তার সম্পদ মর্টগেজ রাখা আছে এবং প্রয়োজন হলে ব্যাংক এই সম্পদ বিক্রয়ের উদ্যোগ নিয়ে ঋণ সমন্বয় করবে। তিনি এটাও নিশ্চিত করেন যে বেলায়েত শুধুমাত্র দিলকুশা শাখা থেকেই ঋণ নিয়েছিলেন, গুলশান বা অন্য কোন শাখা থেকে নয়।

কয়েকটি সংবাদপত্র বেলায়েতের ঋণ নিয়ে প্রতিবেদনে তার শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি আছে বলে জানিয়েছিলো। কিন্তু বেলায়েত বলেন, তিনি কখনোই শিপ ব্রেকিং এ ছিলেন না। তিনি শিপিং ব্যাবসায় জড়িত ছিলেন এবং ছয়বার বাংলাদেশ কারগো ভেসেল ওনারস এসোসিয়াশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি আরও জানান, তিনি তিনবার বাংলাদেশ কোস্টাল শিপ ওনারস এসোসিয়াশনের সভাপতি এবং ওয়াটার ট্রান্সপরট সেলের আহ্বায়ক ছিলেন। তার উদ্যোগেই ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল সই হয়েছিলো বলে বেলায়েত জানান।

বেলায়েতের বিরুদ্ধে দুদকের ৬১টি মামলা রয়েছে বলে যে সংবাদ ছাপা হয়েছিলো, সেই সম্পর্কে তিনি জানান দুদক তার বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেনি। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে তিনি দেশে ফেরার পর একটি অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক তার কানাডায় ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগে একটি চিঠি দিয়েছিলো। এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে রিট করে তিনি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিতে সক্ষম হন তার বিরুদ্ধে মামলা বা কোন প্রমাণ না থাকার কারণেই। পরে আপিল বিভাগও হাই কোর্টের রায় বহাল রেখেছিলো।

কানাডায় তার বিলাসবহুল বাড়ি কেনা নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো সে সম্পর্কে বেলায়েত বলেন, তিনি ২০০৬ সালে কানাডায় যান এবং সাত লক্ষ ক্যানাডিয়ান ডলার দিয়ে সে বছরেই একটি বাড়ি কিনেন। সেই বাড়ি তিনি পরে তিন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে ২.২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আরেকটি বাড়ি কিনেন। সেই বাড়ির ছবিটিই সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে তার বিরুদ্ধে প্রচারণায়।

Similar Articles

Leave a Reply

Top