হাবিবুর রহমান, মধুপুর (টাঙ্গাইল) :
বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড় থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলার সমতল এলাকায় মূলত গারো সম্প্রদায়ের বসবাস। এক সময় তাদের পেশা ছিল কৃষি। তাদের বসবাসরত এলাকায় সমতল কিংবা উচু নিচু পাহাড় টিলায় জুম চাষ করতো। জুম চাষ ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও তারা মাচ্যাং ঘরে বসবাস করতো। পরবর্তী সময়ে আবার অনেক এলাকায় মাটির ঘরেও ছিল তাদের বসবাস। কালের বিবর্তনে ছনের ঘর আর মাচ্যাং বিলুপ্ত হলে মাটির ঘর এখনও টিকে আছে টাঙ্গাইল, জামালপুর ও শেরপুর এলাকায়। বৈচিত্র্যময় জীবনধারার অধিকারী গারোদের ঘর বাড়ি ছিল পরিচ্ছন্ন পরিপাটি। বাড়ির আঙিনায় থাকতো ফুলের সাজানো বাগান। এখনও তাদের সুন্দর সাজানো পরিচ্ছন্ন প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ফুলের সমাহার। থাকার ঘরের পাশাপাশি ছিল নক মান্দি।
গারো সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ” নক মান্দি ” আচিক বা গারো শব্দ। এর অর্থ বৈঠক ঘর।থাকার ঘর। গারোদের বিশেষ ধরনের এক ঘর ইত্যাদি। এই নক মান্দিতে বসে তারা তাদের নানা আচার অনুষ্ঠান করতো। আত্মীয় স্বজন অতিথি আপ্যায়নসহ নানা পর্ব নক মান্দিতেই সম্পন্ন হতো। বিয়ে, শ্রাদ্ধ, আচার অনুষ্ঠানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হতো এই ঘরে বসে। জুম কাটা, ওয়ানগালা, রংচুগালাসহ নানা পর্বের জন্য তাদের চাচ্চি মাহারি গোষ্ঠী আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। নক মান্দির বৈশিষ্ট্য ছিল মাটি থেকে তিন থেকে পাঁচ দশ ফুট উচু মাচ্যাং খুটির উপর দাঁড় করানো। চার দিকে বাঁশের চেগার করা বেড়া। উপরে ছনের ছাউনি। নক মান্দির মধ্যে রাখা হতো আগুন জ্বালানোর জায়গা। শীতকালে নক মান্দির ভেতরে আগুন ধরিয়ে সবাই চারপাশে বসের তাপ পোহাত। নক মান্দি থাকতো সংনকমা বা গ্রাম প্রধানের বাড়িতে। নক মান্দিতে গারোদের ব্যবহার্য বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণ করা হতো। এটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। এ নক মান্দি ছিল গারোদের আদি ঐতিহ্য। ঘর তৈরির উপকরণের অভাব, ব্যয় বুদ্ধি, আধুনিক জীবন যাপন, জুম চাষ বিলুপ্তি, জীবিকার তাগিদে শহরমুখী জীবন যাপনসহ বিভিন্ন কারণে নক মান্দি হারিয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে নক মান্দি সচরাচর দেখা যায় না। তবে তাদের ঐতিহ্য ধরে দরকার বলে মনে করছেন গারো সম্প্রদায়ের লোকেরা। এসব তথ্য স্থানীয় গারো সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
মধুপুর অঞ্চলে গারো ঐতিহ্যবাহী নক মান্দি ধরে রেখেছে প্রয়াত রাগেন্দ্র নকমা। জানা যায়, সাইনামারি গ্রামে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রেখে গেছেন রাগেন্দ্র নামের এক গারো কৃষক। রাগেন্দ্র ছিলেন ঐ এলাকার বড় গৃহস্থ। তার রয়েছে নিজস্ব রাবার বাগান, কৃষির বিভিন্ন চাষাবাদ।
মধুপুর শহর থেকে ১৩ কি.মি. দূরে সাইনামারি গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ঐতিহ্যের নক মান্দি। দোখলা বন বিভাগের অফিস থেকে কাঁচা সড়কে যেতে হয় তার বাড়ি। যাওয়ার পথে আনারস কলার সারি সারি বাগান। এ গ্রামের সিংহভাগ বসতি গারো সম্প্রদায়ের। বাড়ির চার দিকে নানা বৃক্ষরাজিতে ভরা। চার দিকে গাছ বাঁশের বেড়া। বাড়ির মুল ফটকে দিয়ে প্রবেশ করে দেখা গেল, একটি মাটির ঘর। দুই পাশে টিনের আর কাঠের দোতলা ঘর। ডানপাশে মাচ্যাং উপর করা নক মান্দি। রাগেন্দ্র নকমা মারা যাওয়ার পর মাতৃতান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী এ বাড়ির দায়িত্ব পেয়েছে তার মেয়ের জামাই। এ সংসারের নক্রম হিসেবে দায়িত্ব তিনি পালন করেন। নক মান্দির তিন দিকে সুন্দর বেড়া আর সামনের অংশ পুরোটা খালি। সামনের অংশে ফুলের গাছ লতা পাতায় ঘেরা। মাটি থেকে খুঁটির উপরে কাঠের তক্তা দিয়ে পাটাতন করা। পিছনের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখা যায়।
নক্রম জানালেন, তার শ্বশুড় এ নক মান্দি করেছেন। এ নক মান্দিতে বসে তারা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করে থাকে। তার শ্বশুড়ের করা ঐতিহ্যবাহী নক মান্দি ধরে রাখবেন বলে জানান।
আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং বলেন, নক মান্দি হলো গারো সম্প্রদায়ের আদি ঐতিহ্য। এ ঘরে নানা অনুষ্ঠান হতো। চু বা পানীয় খাওয়া হতো, অতিথি আপ্যায়ন করা হতো। শীতের দিনে আগুন পোহানো হতো। এই নক মান্দি ঘর তৈরি ব্যয় বহুল হওয়ার কারণে অনেকেই করতে পারে না। তাই ধীরে ধীরে এটি হারিয়ে যাচ্ছে। এ প্রজন্মের সন্তানরা নক মান্দি সম্পর্কে অনেকটাই জানে না। তার মতে, প্রতিটি সমাজে বা সামর্থবানরা যদি নক মান্দি তৈরি করে তাহলে এ প্রজন্ম নক মান্দি সম্পর্কে জানতে পারবে।
গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিল বলেন, নক মান্দি হলো গারোদের বিশেষ ধরনের ঘর। জুম চাষের সময় গারো সম্প্রদায়ের লোকেরা নক মান্দি তৈরি করতো। এ ঘরে চলতো তাদের নানা অনুষ্ঠান পার্বন। নক মান্দি তৈরিতে ছন বাঁশ লাগত, এখন ছন না পাওয়ায় এ ঘর তেমন তৈরি হচ্ছে না। তিনি বলেন, আবার বাড়িতে ছেলে সন্তান প্রাপ্ত বয়স হলে তার জন্যও এ ঘর তৈরি করা হতো।
আবিমা ডেভেলপমেন্ট ফোরামের নেতা অজয় এ মৃ বলেন , নক মান্দি থাকতো সংনকমা বা গ্রাম প্রধানের বাড়িতে নক মান্দিতে হতো নানা অনুষ্ঠান, থাকতো গারোদের নানা বাদ্যযন্ত্র। সংনকমা প্রথা অনেকটা না মানার কারণে নক মান্দি হচ্ছে না। যার ফলে নতুন প্রজন্ম নক মান্দি সম্পর্কে তেমনটা জানতে পারছেনা। তার মতে, আবার নক মান্দি ফিরিয়ে আনা দরকার। এতে তাদের ব্যবহার্য বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণ হবে, ঐতিহ্য ফিরে আসবে নক মান্দির।
সংনকমা প্রথা চালু হলে স্থাপন হবে নক মান্দি। আর নক মান্দির ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গারোদের ব্যবহার্য বাদ্যযন্ত্রসহ নানা জিনিসপত্র সংরক্ষণ হবে। ঐতিহ্য ফিরে আসবে নক মান্দির। নতুন প্রজন্ম তাদের আদি ঐতিহ্য জানতে পারবে, শিখতে পারবে এমনটা ধারণা সংশ্লিষ্টদের।