হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহতদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। ওই হামলার ঘটনার ছয় বছর পূর্তিতে আজ হলি আর্টিজান ভবনের সামনে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে পূষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তারা নিহতদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সকাল সাড়ে ৭টায় প্রথম শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। এরপর ইতালির রাষ্ট্রদূত ইনরিকো নুনজিয়াতা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস এবং ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আমরা খুবই ব্যথিত। বাংলাদেশের পুলিশসহ সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, ঘটনাগুলো কেন ঘটেছে, আমাদের উচিত যৌথভাবে এসব মোকাবেলা করা, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।’
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ‘ছয় বছর আগের এই ঘটনায় আমাদের সাতজন নাগরিক মারা গেছেন, তারা সবাই জাইকার ঢাকা মেট্রো লাইন-১ প্রজেক্টে কাজ করতেন। তারা রিসার্চের কাজ করছিলেন। আমরা তাদের কখনও ভুলব না, ওইদিন কি ঘটেছিল তা আমরা কখনও ভুলব না! তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ ও সম্পর্ক রয়েছে। এই সেপ্টেম্বরে লাইন-১ এর কাজ শুরু হবে। এই কাজটা চালিয়ে যাওয়া এবং শেষ করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের দায়িত্ব।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসের সব থেকে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। সেদিনের ওই ভয়াল রাতে গুলশান-২ এর হলি আর্টিজান বেকারিতে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২২ জন। সেদিন রাত ৮টা ৫০মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস এক জঙ্গি হামলার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছিল গোটা জাতি। পরের দিন ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার। ওই অপারেশনে নিহত হয় হামলাকারী ৫ জঙ্গি।
হলি আর্টিজান হামলায় সরাসরি অংশ নেয় উচ্চ শিক্ষিত পাঁচ জঙ্গি। তারা জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হামলায় অংশ নেয় মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির ছাত্র নিবরাস ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার সাবেক ছাত্র মীর সামিহ মোবাশ্বের, বগুড়ার বিগিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদরাসার সাবেক ছাত্র খায়রুল ইসলাম পায়েল, বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজের ছাত্র শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
জঙ্গিদের হামলায় যে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন তারা হলেন, ডিবির সহকারি কমিশনার (এসি) মো. রবিউল করিম ও বনানী থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান। এছাড়াও
জঙ্গিদের হাতে নিহত আরো ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানের, ১ জন ভারতের ও ৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক।
এদিকে, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ৭ আসামিকে মৃত্যুদন্ড এবং এক আসামিকে খালাস দেন বিচারিক আদালত। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এ রায় দেন।
দন্ডপ্রাাপ্তরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
একই বছরের ৩০ নভেম্বর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৭ আসামির ডেথরেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে আসে। এর পরেই তৎকালিন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। এরপর আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আর রায়ে খালাস পাওয়া একজনের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
অপরদিকে, জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দেশে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪১০ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে র্যাবের হাতেই গ্রেফতার হয়েছে ১ হাজার ৬৭৮ জন।
এদিকে জঙ্গি দমনের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের দ’ুটি ইউনিট গ্রেফতার করেছে ৭৩২ জনকে। এর মধ্যে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যদের হাতে গ্রেফতা হয় ৫৫৯ জন এবং অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটিইউ) গ্রেফতার করেছে ১৭৩ জনকে।