বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে ভোগেন। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ তাদের স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনীর রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর শীর্ষ কারণগুলোর মধ্যে উচ্চরক্তচাপ তৃতীয় এবং হৃদরোগ সংক্রান্ত মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকের সাথে এটি সরাসরি সম্পৃক্ত।
সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউট (এনজিএইচআই) ও রংপুর হাইপারটেনশন এন্ড রিসার্চ সেন্টার (এইচএন্ডআরসি-রংপুর) বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত আঠারোর্ধ ব্যাক্তিদের মধ্যে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। সর্বমোট ২,২৭৬ জন উচ্চরক্তচাপের রোগী, যারা ২০২০-২১ সালের মধ্যে হাইপারটেনশন এন্ড রিসার্চ সেন্টার, রংপুরে সেবা নিয়েছেন, তাদেরকে এই গবেষণার আওতায় আনা হয়। হাইপারটেনশন এন্ড রিসার্চ সেন্টার, রংপুর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শুধুমাত্র উচ্চরক্তচাপ সংক্রান্ত স্বাস্থসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ।
এই গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরমর্শ দেয়া স্বত্তেও শতকরা ৬০ ভাগের বেশী রোগী অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপে ভোগেন। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপের জন্য প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ রোগী স্ট্রোক এবং হৃদরোগের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন।
শতকরা ৫২ ভাগ উচ্চরক্তচাপের রোগীর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওজন অথবা স্থুলকায় আকৃতি পরিলক্ষিত হয়েছে- যা খুবই দুশ্চিন্তাজনক। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ওজন বজায় রাখা দরকার, যার জন্য জীবনযাত্রার ধারায় পরিবর্তন আনা জরুরী।
এই গবেষণা থেকে আরও দেখা গেছে যে- চিকিৎসকের পরামর্শসত্ত্বেও প্রায় এক তৃতীয়াংশ রোগী পুনরায় চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিতে যাননি, প্রায় দুই তৃতীয়াংশ রোগী তাদেরকে দেয়া খাদ্যাভাস সংক্রান্ত পরামর্শ মেনে চলেননি এবং প্রায় ৫৫ শতাংশ রোগী শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলেছেন।
আরও দেখা গেছে যে, ১৫% উচ্চরক্তচাপের রোগী তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, এবং আরও প্রায় ৭৫% রোগী ছিলেন যারা অনিয়মিতভাবে ঔষধ সেবন করছেন। গবেষণার অন্তর্ভুক্ত রোগীদের অর্ধেকের উচ্চরক্তচাপের পাশাপাশি অন্যান্য রোগ ছিলো। অতএব, উচ্চরক্তচাপের রোগীদের সেবায় বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন রয়েছে।
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীদের চিত্র খুবই দুঃশ্চিন্তাজনক কারণ তাদের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঔষধ সেবন, চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিতে যাওয়া এবং খাদ্যাভাস সংক্রান্ত পরামর্শ মেনে চলার প্রবণতা খুবই কম।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, “নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং হাইপারটেনশন এন্ড রিসার্চ সেন্টার, রংপুর কর্তৃক পরিচালিত এই গবেষণাটি উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এরকম গবেষণা আরও বেশি বেশি হওয়া উচিৎ। কারণ, বিদেশে পরিচালিত গবেষণার ফলাফলের চেয়ে স্থানিয়ভাবে পরিচালিত আমাদের নিজস্ব গবেষণার ফলাফল উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের কার্যকর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।“
ঢাকা মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর বলেন, “মানুষ হৃদরোগ নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকে। অথচ, হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে চাইলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলুরের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।“
হাইপারটেনশন এন্ড রিসার্চ সেন্টার, রংপুরের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডাঃ জাকির হোসেন বলেন, “অনিয়মিত ঔষধ সেবন ও চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ গ্রহণ করতে না যাওয়া উচ্চরক্তচাপের রোগীদের সেবার কার্যকারিতাকে বিঘ্নিত করতে পারে। নিয়মিতভাবে চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ গ্রহণ না করলে তা স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনীর রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে”।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের পরিচালক, ডাঃ আহমেদ হোসেন বলেন- “বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে একাধিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ-সেবাকর্মী নেই। এই অঞ্চলে আমাদের প্রচুর জনসচেতনাতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার যাতে রোগীদের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ঔষধ সেবনের প্রবণতা বাড়ানো যায়। জাতীয় দুরারোগ্য প্রতিরোধ কার্যক্রমকে সফল করার জন্য আমাদের বহুসংক্ষক কমিউনিটি স্বাস্থ বিশেষজ্ঞ দরকার। সবার জন্য কার্যকরী স্বাস্থসেবা নিশ্চিতকরণে এসডিজি ২০৩০ অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরও কার্যকরী ভূমিকা নেয়ার সময় এখনই”।