প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে (ভার্চুয়াল) গতকাল দেশের ৮৫ জন গুণী ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে দেয়া হয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আট বছর ক্রীড়াঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেয়া ক্রীড়া পুরস্কারে ২০১৭ সালের জন্য যে ১১ জন পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সভাপতি শেখ বশির আহমেদ মামুন। ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরে তিনি দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের। বর্তমানে ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের (বিওএ) সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ এই খেতাবে ভূষিত হওয়ায় অত্যন্ত আনন্দিত খেলাধুলা অন্ত:প্রাণ এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। পুরস্কার পাওয়ার পর বাসসকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি আনন্দিত ও গর্বিত, এটি একটি বড় পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমি খুবই আনন্দিত ও সম্মানিতবোধ করছি। এজন্য সরকার প্রধান এবং যারা এই পুরস্কারের জন্য আমাকে মনোনীত করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শেখ বশির আহমেদ মামুন জিমন্যাস্টিকসের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রথম অলিম্পিক পদক উপহার দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তার দেয়া সাক্ষাৎকারটি নিচে দেয়া হলো।
প্রশ্ন: জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রাপ্তিতে আপনার প্রতিক্রিয়া?
উত্তর: আমি আনন্দিত, সম্মানিত ও গর্বিত। এটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ পুরস্কার। এজন্য সরকার প্রধান এবং যারা এই পুরস্কারের জন্য আমাকে মনোনীত করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
প্রশ্ন: ক্রীড়াঙ্গনে আসার নেপথ্যে কে আপনাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?
উত্তর: আসলে ক্রীড়াঙ্গনে আসার পেছনে আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হচ্ছেন আমার বাবা। তিনি খেলার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। বাবাকে দেখেছি ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে তিনি যে কেবল ঢাকাতেই এসেছেন তা নয়, কলকাতা কিংবা মুম্বাইতেও গেছেন। সঙ্গত কারণেই আমারও খেলার প্রতি দূর্বলতা জন্মেছে।
স্কুলে পড়ার সময় ফুটবল-ক্রিকেট-হকিসহ যে সব গেমসগুলো বার্ষিক ক্রীড়ায় অনুষ্ঠিত হতো, সেগুলো দেখে এবং অংশ নিয়ে আমি খুবই আনন্দ পেতাম। তাই খেলার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতাম। অবশ্য খেলায় অংশগ্রহণের চেয়ে খেলা আয়োজনের দিকেই আমার ঝোঁক ছিল বেশি। অন্য খেলা নিয়ে সমান আগ্রহ থাকলেও স্কুল জীবনে আমি হকির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। হকি খেলেছি স্কুল দলের হয়ে। তবে ফুটবল এবং ক্রিকেটও তখন ছিল দারুণ পছন্দের। যদিও বেশী দূর এগুতে পারিনি। তবে সংগঠক হিসেবে আমি স্কুলজীবন থেকেই ভুমিকা রাখার চেষ্টা করতাম।
সকালে উঠে মাঠে যেতাম খেলতে এবং খেলার আয়োজন করতে। আর এতে উৎসাহিত করতেন আমার বাবা-মা। তারা বলতেন খেলাধুলা করো, খেলাধুলা করলে শরীর ও মন ভালো থাকে।
স্কুলজীবন শেষ করে সাতক্ষীরা থেকে আমি ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। সেখান থেকে বুয়েট। এরই মধ্যে প্রয়াত শেখ কামালের দূরদর্শি নেতৃত্বে জন্ম হয় আবাহনী ক্লাবের। তিনি সেই সময় ছিলেন আমাদের আইকন। আমরা আবাহনী ক্লাবে যেতাম খেলা দেখতে। আবাহনী ক্লাবে যোগ দিয়ে আমি ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়ে মেতে উঠি। আস্তে আস্তে সমর্থক থেকে ক্লাবের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে ছিল শেখ কামালের উৎসাহ। তিনি আমাদের তাগিদ দেন ক্লাবের কর্মকান্ডের সঙ্গে একাত্ম হতে। আমরা দ্বিধা করিনি।’
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের বর্তমান অবস্থানে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট ?
উত্তর: বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের বর্তমান অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। অনেক বেশী সংগঠিত এবং অনেক বেশী লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। বিভিন্ন খেলায় আমরা আন্তর্জাতিকভাবে ভালো করছি। তবে আমাদের আরো ভালো করা উচিৎ ছিল। এভাবে সুসংগঠিতভাবে আমরা আগে আসতে পারিনি। বিগত চার থেকে আট বছর ধরে আমরা পরিকল্পিত ভাবে এগিয়ে চলেছি। যাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গেমসগুলোতে আমরা ভালো করতে পারি। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থা যেমন অলিম্পিক এসোসিয়েশন ও বিভিন্ন ফেডারেশন এগিয়ে চলেছে।তবে এতে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে আরো বেশী ভুমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে যেসব খেলা বেশি সম্ভাবনাময়, সেগুলোকে প্রধান্য দিতে হবে। তাতে আমরা ওইসব খেলাগুলোকে আরো পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গন আরো সাফল্য পাবে।
প্রশ্ন: ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে আপনার পরামর্শ কি?
উত্তর: ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের জন্য এ দেশের খেলাগুলোকে ভাগ করে নিতে হবে। কোন খেলাকেই বাদ দেয়া যাবে না। তবে যেসব খেলায় সফলতা পাবার সুযোগ বা সম্ভাবনা বেশী, যেসব খেলায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের সফলতা পাবার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যেসব খেলায় আঞ্চলিক পর্যায়ে ভালো করতে পারবে, সেগুলো ঠিক না করা পর্যন্ত আমরা খুব বেশী এগুতে পারব না।
আমাদের দেশে কয়েকটি খেলা এখন বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছে গেছে। তবে আরো ৭-৮টা সম্ভাবনাময় ডিসিপ্লিন রয়েছে। আপনি যদি ৪৫ থেকে ৫০টা ফেডারেশনের সবগুলো এক চোখে দেখেন, তাহলে কখনোই খেলার উন্নতি হবে না। দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। আর সে ধরনের প্রশিক্ষণ দিতে গেলে এতগুলো ফেডারেশনকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়, কারণ আমাদের ওই পরিমাণ আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। ফেডারেশনগুলোকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করে তুলতে হবে, যাতে তারা দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা। ফেডারেশনের অর্থ দিয়ে নিজেরাই কোচ আনতে পারে এবং বিদেশী কোচের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। এগুলো না করলে দ্রুত উন্নতি সম্ভব নয়।
খেলাধুলায় শর্টকাট কোন পথ নেই। এটি দীঘ মেয়াদী। যারা দীর্ঘ সময় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে তারাই উন্নতি করছে। যারা পারছে না তারা পিছিয়ে পড়ছে। তাই যে সব খেলায় সম্ভাবনা আছে, প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ আছে সেগুলোকেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে স্তর ভাগ করে দিলে সুফল আসতে পারে। বাংলাদেশ গেমসের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমনই একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন স্তর ভাগ করে দিতে। তার নির্দেশনা যদি অনুসরণ করা যায়, তাহলে আমরা দ্রুতই বেশ কয়েকটি ডিসিপ্লিনে ভালো করতে পারব, ইনশাল্লাহ। সর্বোপরি আমাদের সর্বক্ষেত্রে পেশাদারীত্বকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
প্রশ্ন: জিমন্যাস্টিকসের উন্নয়নের জন্য আপনার নতুন কোন পরিকল্পনা আছে কিনা?
উত্তর: আমি প্রায় এক যুগ ধরে জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। বিভিন্ন পরিকল্পনাও করেছিলাম্ শেষ পর্যন্ত অনুধাবন করলাম তরুণদের নিয়ে যদি খেলোয়াড় তৈরি করতে না পারি, তাহলে একটি পর্যায়ে এসে তারা হারিয়ে যাবে এবং যাচ্ছে। প্রথমদিকে আমি উপর থেকে করতে চেয়েছিলাম, যেটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন আমি খুবই উন্নত মানের একজন কোচ আনতে যাচ্ছি, যার কথা এখনো প্রকাশ করিনি। যিনি কোরিয়ার জিমন্যাস্টিকসকে বিশ্ব পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন।
তার পরিকল্পনা প্রথমদিকে কোরিয় সরকার গ্রহণ করেনি। ফলে তিনি পদত্যাগ করে চলে যান। ৫ বছর পর দেশটির সরকার তাকে ডেকে এনে দায়িত্ব দিয়েছিল। যার সুফল হিসেবে কোরিয়া এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ থেকে শুরু করে অলিম্পিকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক লাভ করছে। সেই বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ কোচকে আমি বাংলাদেশে আনার পরিকল্পনা করেছি। তাঁর সাথে আমার আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তার নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা যদি দেড় থেকে দুই বছর একটানা কোচিং করাতে পারি, তাহলে উপমহাদেশের বড় আসরেই দলকে ফল এনে দিতে পারবো। এটিই তার শেষ পরিকল্পনা। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষেই তিনি অবসর নিতে চান। বাংলাদেশের জিমন্যাস্টিকসকে অনন্য এক জায়াগায় পৌঁছে দিয়ে তিনি নিজের সুনামকে অক্ষুন্ন রাখতে চান। আমিও তার নির্দেশনা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছি। শীঘ্রই তার সম্পর্কে আমি গণমাধ্যমকে জানাবো।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের জিমন্যাস্টিকসকে আপনি কোথায় দেখতে চান?
উত্তর: কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে একটি স্লোগান সবসময়ই আমি মনেপ্রাণে ধারণ করার চেষ্টা করি। সেটি হলো, অলিম্পিকের পদক প্রাপ্তি তাদের স্বপ্ন। তাদের স্লোগান হচ্ছে ‘অলিম্পিকের পদক চাই’। জিমন্যাস্টিকসের মাধ্যমে আমি বাংলাদেশকে অলিম্পিকের প্রথম পদক উপহার দিতে চাই। এটাই আমার স্বপ্ন, এটাই আমার পরিকল্পনা।
উল্লেখ্য ২০০৮ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সভাপতি হিসাবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন শেখ বশির আহমেদ মামুন। ২০১৩ সাল থেকে সহ-সভাপতি হিসাবে আছেন বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনে। ২০১১ সালে তার উদ্যোগেই আয়োজিত হয় সুলতানা কামাল সেন্ট্রাল-সাউথ এশিয়ান জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতা। এটাই ছিল বাংলাদেশে আয়োজিত জিমন্যাস্টিকসের প্রথম কোন আন্তর্জাতিক আসর। এই প্রতিযোগিতায় অসামান্য ক্রীড়ানৈপূণ্য দেখিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন বাংলাদেশের সাইক সিজার। এরপর গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ঢকায় অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ স্বর্নপদক না পেলেও তৃতীয় স্থান লাভ করে। এ প্রতিযোগিতার মূল আকর্ষণ ছিল মারগারিটা মামুন। রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করা বাংলাদেশী এ জিমন্যাস্ট পদক জিতেছেন অলিম্পিক গেমসে। মূলত শেখ বশির আহমেদ মামুনের একক প্রচেস্টায়ই আনা হয়েছিল মারগারিটা মামুনকে।
২০১৪ সালের ইনচন এশিয়ান গেমস ও ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ ক্রীড়া দলের শ্যেফ দ্য মিশনের দায়িত্ব পালন করেন শেখ বশির আহমেদ মামুন। এছাড়া জিমন্যাস্টিকসে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৪ সালে ইনচনে এশিয়ান জিমন্যাস্টিকসের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে বিশেষ সম্মননা প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত যুব গেমস সফলভাবে আয়োজনের জন্য তিনি পেয়েছেন বিশেষ স্পন্সর অ্যাওয়ার্ড। ওই গেমসের ব্যাপকতা ও এর মডেল বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিতে। যুব গেমসের সফল ক্রীড়াবিদরাই বর্তমানে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্য দেখাচ্ছে।
২০১৯ সালে শেখ মামুনের ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষণায় সিঙ্গাপুর ওপেন জিমন্যাস্টিকসে বয়স ভিত্তিক ও জুনিয়র বিভাগ থেকে ১৪টি স্বর্ণ, ৫টি রৌপ্য ও ৯টি ব্রোঞ্জপদক জয় করে বাংলাদেশের জিমন্যাস্টরা। একই বছর হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল হাঙ্গেরিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে দুটি স্বর্ণপদক জয় করে বাংলাদেশ।