জাতিসংঘে বাংলায় দেয়া ভাষণ ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সুন্দরতম ও সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৪ সালের এদিনে (২৫ সেপ্টেম্বর) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আগের বছরগুলোর মতই নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন।
১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশের মর্যাদা লাভ করে। এর মাত্র সাত দিন পর, ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। জাতিসংঘে এটি ছিল প্রথম বাংলায় ভাষণ। এতে করে বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মানের আসন, আর এই ভাষাভাষীর মানুষেরা পেয়েছে গর্ব করার অবকাশ।
অনেকেই মনে করেন, বিশ্বপরিসরে এরআগে এমন করে বাংলাভাষাকে কেউ পরিচয় করিয়ে দেননি। বাঙালি অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বের দরবারে তাদের পরিচিত করলেও কেউ বাংলায় বক্তব্য রাখেননি। সে কারণে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণে বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মানের আসন। আর এই ভাষাভাষীর মানুষেরা পেয়েছে গর্ব করার মত বিষয়। এ ভাষণের আর একটি দিক ছিল এটি সমগ্র বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ।
ভারতের প্রখ্যাত লেখক ও গ্রন্থ সমালোচক সুরজিৎ দাশগুপ্ত জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় দেয়া ভাষণকে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) জীবনের সুন্দরতম ও সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে অবিহিত করে বলেছেন, এর আগে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও লাহোরে মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে রাজি হলেন এই শর্তে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে। পাকিস্তানের স্বীকৃতির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের স্বীকৃতি এবং এই সঙ্গে জাতিসংঘে প্রবেশের অধিকার আর বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম ভাষারূপে প্রতিষ্ঠার সুযোগ।
‘শেখ মুজিবুর রহমান : ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ গ্রন্থে সৈয়দ বদরুল আহসান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করেছেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের নয়াদিল্লী থেকে। প্রকাশক নিয়োগী বুকস। গ্রন্থটির আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক ও গ্রন্থ সমালোচক সুরজিৎ দাশগুপ্ত এই গ্রন্থটিকে রোমাঞ্চকর হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তথ্য-পরিবেশনে, বিশ্লেষণে এবং রচনাশৈলিতে আলোচ্য গ্রন্থটি দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গ্রন্থাবলির তালিকায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ ‘দেশ’ পত্রিকায় তার নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
তিনি বলেন, এটা ঘটনা যে, জাতিসংঘের দরবারে ভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাই সারণি-স্বীকৃত ভাষা। স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪’র সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলা ভাষার এই গৌরব প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ভাষার জন্যই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ‘অমর একুশে’র ঐতিহাসিকতা অর্জন করে। এর ৪৮ বছর পর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় উল্লেখ করে সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাসিম, কামিনী কুমার দত্ত, শহিদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ তৎকালীন বাংলার নেতৃবৃন্দ। তখন মুজিবুর ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর একান্ত অনুগত। সেই সময় থেকে তিনিও স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতেন।
তিনি বলেন, মুজিবুর কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে সেখানেও ছাত্রনেতা হলেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেফতার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তি পান। আবার আইন অমান্যের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৯ এপ্রিল গ্রেফতার হন। মুক্তি পান ২৭ জুলাই। চার মাস পর খাদ্য আন্দোলনের নেতা হিসেবে আবার কারাবাস। বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন জেলে একটানা প্রায় দু’বছর বন্দি রেখে ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে যখন তাকে মুক্তি দেয়া হয়, তখন তাঁকে স্ট্রেচারে করে বাড়ি নিয়ে যেতে হয়।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ঐতিহাসিক এ দিনটির সূচনা হয় একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, এই ঘোষণাটি শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’
তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই ২৯তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। সর্বমোট ২৪ সদস্যের সফরসঙ্গীর মধ্যে আরও ছিলেন- পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও অয়েল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমান, এমআর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান এমপি, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে প্রতিনিধি দলটি ঢাকা ত্যাগ করে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল, ইংরেজিতে বক্তৃতা করার জন্য।’কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চান।’ সিদ্ধান্তটি তিনি আগেই নিয়েছিলেন উল্লেখ করে তোফায়েল বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরু দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার।