বাণিজ্যিক ভাবে চুয়াডাঙ্গায় উচ্চ ফলনশীল জাতের কুল চষে হচ্ছে। কুল বাগান গুলো পাঁকা-কাঁচা কুলে থোকায় থোকায় ভরে গেছে। বাজারে বলসুন্দরি, কাশ্মীরি, ভারতসুন্দরি ও টক-মিষ্টি কুলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ছোট-বড় বাগান গড়ে উঠেছে । অল্প সময়ে কুল চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় কৃষক ও শিক্ষিত বেকার যুবকরা বাগান গড়ে তুলছেন। ৬ বছর আগে প্রথম চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় ৯ বিঘা জমিতে গড়ে উঠে কুল বাগান।এ কুল খেতে সুস্বাদু, মিষ্টি, রসালো ও সাইজে অন্য কুলের চেয়ে বড়। কুল চাষিরা বলছেন, আড়তদারদের অনিয়মের কারণে বাগান মালিকরা দাম কম পাচ্ছেন। আর সাধারণ ক্রেতাদের চড়া মূল্যে দিয়ে কুল কিনতে হচ্ছে। বাগান মালিক ও ক্রেতাদের মধ্যে কেনা-বেচার পার্থক্য থাকে প্রতি কেজিতে ৪০-৫০ টাকা। কুল উচ্চ ফলনশীল জাতের ফল হওয়ায় শীতকালে বাজারে চাহিদা থাকে ব্যাপক। চুয়াডাঙ্গার বাজারে কুলের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, খুলনা, চট্রগ্রাম, রাজশাহিসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার লোকনাথপুর গ্রামে প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে উচ্চ ফলনশীল জাতের কাশ্মীরি কুল চাষ শুরু হয়। এর পর জেলায় ছড়িয়ে পরে বলসুন্দরি, কাশ্মীরি, ভারতসুন্দরি ও টক-মিষ্টি জাতের কুল চাষ। ৩৮৭ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩শ কুল বাগান রয়েছে। চারটি জাতের কুল চাষ করা হয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় চাহিদা রয়েছে এ জাতের কুলের। কৃষক ও উদ্যোক্তরা জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে কুল বাজারে বিক্রি শুরু করেছেন। এ বছর ৩৮৭ হেক্টর জমির কুল বাগান থেকে প্রায় ৩০৯৬ মেট্রিক টন ফল পাওয়া যাবে।
চুয়াডাঙ্গায় চাষ হচ্ছে বলসুন্দরি, কাশ্মীরি, ভারতসুন্দরি ও টক-মিষ্টি জাতের কুল। বলসুন্দরি জাতের কুলের চাহিদা বাজারে বেশি। কৃষক ও উদ্যোক্তারা এ জাতের কুল বাগান গড়ে তুলছেন। অল্প সময়ে কুল লাভজনক চাষ হওয়ায় কৃষক ও উদ্যোক্তরা অন্য ফল চাষে আগ্রাহ দেখাচ্ছেন না।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৭০ হেক্টর, আলমডাঙ্গায় ২৫ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ১৭৪ হেক্টর ও জীবননগর উপজেলায় ১১৮ হেক্টর জমিতে বলসুন্দরি, কাশ্মীরি, ভারতসুন্দরি ও টক-মিষ্টি জাতের কুল চাষ হচ্ছে। বলসুন্দরি জাতের কুলের চাষ সব চেয়ে জেলায় বেশি। কারণ এ কুলের উৎপাদন অনেক বেশি।
কুল গাছ লাগানোর ৭ মাস পর থেকে গাছে ফুল আসতে শুরু হয়। কুলের কাঁচা-পাকায় গায়ের রঙ সবুজ, হলদে, গাঢ় খয়েরি ও ভিতরের রঙ সাদা। প্রতি বিঘায় কুল বাগানে বছরে খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। খরচ বাদে বিঘায় প্রায় ১ লাখ টাকা লাভ হয়। শিক্ষিত বেকার যুবকরা কুল বাগান দেখে চাষে আগ্রাহ দেখাচ্ছেন। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা দরে। কুলের সাইজ বড় হওয়ায় এক কেজিতে ১৪-১৮টি হয়। কুল গাছের ডাল থোকায় থোকায় কুলে ভরে গেছে। কুলের ভারে ডাল গুলো মাটিতে নুইয়ে পড়ছে। ডাল গুলো ভেঙে না যায় সেজন্য বাঁশের খুটি দিয়ে ঠেকনো দেওয়া হয়েছে। আর নাইলনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেধে দেওয়া হয়েছে ডাল। পাঁকা কুল পাখিতে বেশি নষ্ট করে বাগান গুলোতে। পাখি তাড়ানোর জন্য বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। পোকা-মাকড় দমন করার জন্য গাছে ঝোলানো হয়েছে ফরেমন ফাঁদ। চাষে কৃষকরা জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বেশি করেন।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সাতগাড়ী গ্রামের কুলবাগানের মালিক শিমুল হোসেন পলক বলেন,কালীগঞ্জ বোর্ডার থেকে বল সুন্দরী ৫০০ ও ভারতসুন্দরী২০০ চারা নিয়ে ২০২১ সালে আড়াই বিঘা জমিতে রোপণ করি ।আমার জমি তৈরি করা থেকে ফল আসা পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। চারা রোপণের ৭-৮ মাসেই গাছে কুল আসে । ইতোমধ্যে প্রায় দেড় লাখ টাকার কুল ও কুলের চারা বিক্রি করেছি।তিনি জানান বলসুন্দরী কুল ১হাজার২০০ টাকা থেকে ১হাজার ৩০০ টাকা ও ভারত সুন্দরী ২ হাজার৪০০ থেকে ২ হাজার৬০০ টাকা মণ দরে বিকিকিনি করছি। জেলার কৃষি উদ্যোক্তারা আমার বাগান থেকে চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা গাইদঘাট গ্রামের কুল বাগান মালিক সেলিম হোসেন বলেন, আমরা কুলের দাম পাইনা। আড়তদাররা আমাদের কুল বিক্রি করে এক কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বেশি লাভ করে। কিন্তু আমাদের দাম দেওয়া হয় ৩০-৪০ টাকা। ফলে লাভ কম হয়, খরচ বাদে কোন সময় লোকসানের মুখে পড়তে হয়। ১০ বিঘা জমিতে বলসুন্দরি ও ৩ বিঘা জমিতে কাশ্মীরি জাতের কুল চাষ করছি। বাগানে প্রতিদিন ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
চুয়াডাঙ্গা সাতগাড়ি গ্রামের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা শিমুল হোসেন পোলক জানান, ঢাকায় চাকরি ছেড়ে চুয়াডাঙ্গায় ফিরে কৃষি নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করি। সেই চিন্তা থেকে ভারতসুন্দরি ও বলসুন্দরি জাতের কুল চাষ করছি ৬ বিঘা জমিতে। বাগানের বয়স ৯ মাস। ফলন ভালো হওয়ায় বিঘায় ৭০-৮০ হাজার টাকা লাভ হবে খরচ বাদে। কুল বাগান করতে প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়াও ড্রাগন, পেয়ারা ও পেঁপেসহ অন্য ফসল চাষ করছি।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মদনা গ্রামের কৃষক শাকিল বিশ্বাস বলেন, ভারত থেকে উচ্চ ফলনশীল জাতের কুলের চারা সংগ্রহ করে চাষ করছি। লাভজনক ব্যবসা, খরচ তুলনামূলক অনেক কম। এ চাষে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর। ভালো জাত নির্বাচন করে কুল চাষ করতে হবে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, জেলায় ৩৮৭ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হচ্ছে। বলসুন্দরি, টক-মিষ্টিসহ বিভিন্ন জাতের কুল চাষ হচ্ছে। ভারত থেকে বিভিন্ন জাতের কুল গাছ আসছে। কুল শীতকালীন ফল। বাজারে কুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতারা কাছে। চুয়াডাঙ্গায় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য জেলায় যাচ্ছে। বাগান মালিক ও কৃষকদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।