যৌক্তিক কারণ না থাকা সত্ত্বেও গত এক বছরে শেয়ারবাজারে কিছু শেয়ারের মুল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যার অধিকাংশই বীমা খাতের। এর মধ্যে কিছু শেয়ারের মুল্য এমনকি দশ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে কারসাজির মাধ্যমে এ মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। গত কয়েক দিনে শেয়ারবাজারের একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী ও ডিএসইর সাবেক একাধিক পরিচালক বাজারে বীমা খাতসহ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম কারসাজির মাধ্যমে যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তাতে চরম ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, কোনো কারণ ছাড়া এক বছরে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ গুণ ও ছয় মাসে ৭ গুণ বেড়ে যাওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। একমাত্র ‘কারসাজি’র মাধ্যমেই এটি সম্ভব। বাজার যখন চাঙা থাকে, তখন কারসাজি বেশি হয়। বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনেক ভালো কাজ করছে। কিন্তু কারসাজি বন্ধে এ কমিশনের আরও বেশি সক্রিয় হওয়া উচিত। যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, সেগুলোর বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে জড়িত কারসাজিকারকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
গত বছরের ৯ জুন প্রভাতী ইনস্যুরেন্সের শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১৯ টাকা ৪০ পয়সা। এক বছরের ব্যবধানে মঙ্গলবার তা ১০ গুণ বেড়ে হয়েছে ১৯১ টাকা। গত মার্চেও এটির শেয়ারের দাম ছিল ৭০ টাকার ঘরে। তিন মাসের ব্যবধানে সেটি এখন ২০০ টাকার ঘরে।
এক বছরে ১০ গুণ দাম বাড়লেও গত এপ্রিলে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। জবাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে ‘মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানা নেই’। তবে এ মূল্যবৃদ্ধিতে লাভবান হয়েছেন কোম্পানির মালিকেরাও। কারণ, তাঁদের শেয়ারের দামও এক বছরে ১০ গুণ বেড়েছে।
গত ২ মে এনআরবি কমর্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের শেয়ারের দাম ছিল ১২ টাকা। সেই দাম এক মাসে তিন গুণ বেড়ে মঙ্গলবার দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ৩৮ টাকা ৪০ পয়সায়। ঢাকার বাজারে গত এক মাসে সর্বোচ্চ দাম বেড়েছে এনআরবিসির শেয়ারের। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র দুটির শেয়ারের দাম এখন এনআরবিসির চেয়ে বেশি আছে। ব্যাংক দুটি হলো ব্র্যাক ও ডাচ্–বাংলা। আর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের মিলিয়ে ২৭টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম এনআরবিসির চেয়ে কম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যাংক হচ্ছে সিটি, ইস্টার্ণ, মিউচুয়াল, ব্যাংক এশিয়া ও ট্রাস্ট ব্যাংক। এসব ব্যাংকের শেয়ার এক যুগের বেশি সময় ধরে লেনদেন হচ্ছে। আর চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া এনআরবিসি গত ২২ মার্চ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
২০১৫ সালের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না ঢাকা ডায়িং। এ কারণে কোম্পানিটি মন্দ মানের কোম্পানি হিসেবে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত। কিন্তু এক বছরে কোম্পানিটির ৩ টাকার শেয়ার হয়ে গেছে ১৭ টাকা। মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ৪৩৮ শতাংশ বা ৫ গুণ। অস্বাভাবিক এই মূল্যবৃদ্ধির পরও কোনো তদন্ত নেই। ফলে অব্যাহত আছে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। মঙ্গলবারও কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ২ শতাংশের মতো বেড়েছে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে বিমা খাতসহ অন্যান্য খাতের কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে ‘কারসাজি’র ঘটনা শেয়ারবাজারে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এ কারসাজি নিয়ে চরম বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। কিন্তু কারসাজি তদন্তে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দৃশ্যমান ব্যবস্থা না থাকায় বিএসইসির ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ বাজার–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিমা খাতের শেয়ারের কারসাজি তদন্তে স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন পক্ষ থেকে তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে পাঠানো বীমা কোম্পানিসহ বেশ কিছু কোম্পানির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের এনফোর্সমেন্ট বিভাগে রয়েছে। এর বাইরে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বেশ কিছু কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের তথ্য সংগ্রহ করেছে। কারও বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া কারসাজি রোধে বাজারে তদারকি বাড়ানো হয়েছে।