ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যান্টিগা টেস্টের প্রথম দিনই ১০৩ রানে অলআউট হয়ে গেছে সফরকারী বাংলাদেশ। দলের ছয় ব্যাটার শুন্য হাতে প্যাভিলিয়নে ফিরেন। একা লড়াই করে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫১ রান করেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩২ দশমিক ৫ ওভার টিকতে পেরেছে টাইগাররা।
বাংলাদেশের ইনিংসের পর ব্যাট হাতে নেমে দিন শেষে ৪৮ ওভারে ২ উইকেটে ৯৫ রান করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৮ উইকেট হাতে নিয়ে এখনও ৮ রানে পিছিয়ে ক্যারিবীয়রা।
অ্যান্টিগার স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। উইকেট থেকে শুরুর আর্দ্রতা কাজে লাগাতেই প্রথমে বোলিং বেছে নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট। অধিনায়কের সিদ্বান্তকে সঠিক প্রমান করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসাররা।
ফিটনেস ইস্যুতে পাস করে ম্যাচ শুরুর আগের দিন দলে সুযোগ হওয়া পেসার কেমার রোচ ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই বাংলাদেশ ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয়কে বিদায় ফিরিয়ে দেন। অফ-স্টাম্পের বল ফ্রন্ট-ফুটে খেলেছিলেন জয়। চাইলে অনায়াসে বলটি ছাড়তে পারতেন তিনি। কারন ইনিংসে প্রথম ডেলিভারি ছিলো জয়ের। কিন্তু সামান্য বেশি বাউন্স হওয়াতে বল জয়ের ব্যাটের উপরের অংশ ছুঁয়ে স্লিপে ক্রনকুমার বোনারের হাতে জমা পড়ে। এই নিয়ে ১১ ইনিংসের ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মত শূন্যতে আউট হলেন জয়।
এরপর ইনিংসের তৃতীয় ও নিজের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলে আবারও বাংলাদেশ শিবিরে আঘাত হানেন রোচ। এবার তার শিকার নাজমুল হোসেন শান্ত। রোচের অফ-স্টাম্পের ডেলিভারির লাইনে ব্যাট নিতে পারেননি শান্ত। বল প্যাড-ব্যাটের মাঝ দিয়ে স্টাম্পে আঘাত হানে। ৫ বল খেলে শূন্যতে বিদায় নেন শান্তও।
১৩ বল ও ৩ রানে ২ উইকেট পতনে শুরুতেই চাপে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় রানের খোঁজটা ভালোভাবেই করেছেন বাংলাদেশের ড্যাশিং ওপেনার তামিম ইকবাল। রোচকে দু’বার ও জেইডেন সিলেসকে একবার বাউন্ডারি ছাড়া করেন তামিম।
অফ-ফর্ম কাটাতে টেস্ট অধিনায়কত্ব ছেড়েছিলেন মোমিনুল হক। অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর প্রথম ইনিংসে শুন্য হাতে বিদায় ঘটে মোমিনুলের। সিলেসের অফ-স্টাম্পের বলে ঠিকমত খেলতে না পেরে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ দেন মোমিনুল। ৬ বল খেলেও শূন্যতে বিদায় নেন মোমিনুল।
দলীয় ১৬ রানে ৩ উইকেট পতনের পরও ইনিংসের সপ্তম ওভারে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটার হিসেবে ৫ হাজার রান পূর্ণ করেন তামিম। এই ইনিংস খেলতে নামার আগে ৫ হাজারে পৌঁছাতে ১৯ রান দরকার ছিলো তামিমের।
এরপর ইনিংস মেরামতের কাজ করেন তামিম ও লিটন দাস। ৫৩ বল খেলে থিতুও হয়ে গিয়েছিল তামিম-লিটন।
কিন্তু ১৪তম ওভারে পেসার আলজারি জোসেফের করা লেগ-সাইডের ডেলিভারিটি আউট-সুইং করে বের হয়ে যাওয়া বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তামিম। ৪টি চারে ৪৩ বলে ২৯ রান করেন তামিম। দলীয় ৪১ রানে চতুর্থ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে বাংলাদেশ।
এরপর ১৫তম ওভারে প্রথমবারের মত আক্রমনে এসে বাংলাদেশের বিপদ আরও বাড়িয়ে দেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডিয়াম পেসার কাইল মায়ার্স। মায়ার্সের চতুর্থ ডেলিভারিটি বেশি সামনে এসে খেলতে গিয়ে ব্যর্থ হন লিটন। ব্যাট ছুঁয়ে বল জমা পড়ে উইকেটের পেছনে। ২টি চারে ৩৩ বলে ১২ রান করে আউট হন ইন-ফর্ম লিটন।
একই ওভারের শেষ বলে উইকেটরক্ষক নুরুল হাসানকে দুর্দান্ত এক ইন-সুইংয়ে বিদায় দেন মায়ার্স। মায়ার্সের ইনসুইংয়ের বল না খেলে, পা দিয়ে সামলাতে গিয়ে লেগ-বিফোর হন নুরুল। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি তিনি। ২ বল খেলে আম্পায়ার্স কলে খালি হাতে ফিরেন তিনি। প্যাভিলিয়নে ফেরা ছয় ব্যাটারের চারজনই খালি হাতে বিদায় নেন। প্রথম সেশনের ১৫ ওভারের মধ্যে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
সপ্তম উইকেটে জুটি বেঁেধ উইকেট পতনের ¯্রােত ঠেকান সাকিব ও মেহেদি হাসান মিরাজ। পাল্টা আক্রমনের চেষ্টা করেন সাকিব। ১৮তম ওভারের প্রথম বলে আকাশে বল তুলে দিয়ে সিলেসের হাতে জীবন পান সাকিব। ১৯তম ওভারে বোলার মায়ার্সের মাথার উপর দিয়ে লং-অফে ছক্কা মারেন সাকিব।
সাকিব-মিরাজের প্রতিরোধে তাই প্রথম সেশনে আর কোন উইকেট পড়েনি বাংলাদেশের। ফলে ২৫ ওভারে ৬ উইকেটে ৭৬ রান নিয়ে মধ্যাহ্ন-বিরতিতে যায় বাংলাদেশ।
তবে বিরতি থেকে ফেরার পর প্রথম ওভারেই বিচ্ছিন্ন হয় সাকিব-মিরাজ জুটি। সিলেসের লেগ সাইডের বলটি খেলতে গিয়ে উইকেটে পেছনে ক্যাচ দেন মিরাজ। ৫০ মিনিট উইকেটে থেকে ২২ বলে ২ রান করেন মিরাজ। ৬৬ বলে খেলে দলকে গুরুত্বপূর্ণ ৩২ রান এনে দেন সাকিব-মিরাজ জুটি।
মিরাজ ফেরার ৯ বল পর আবারও উইকেট হারায় বাংলাদেশ। মুস্তাফিজুর রহমানকে নিজের তৃতীয় শিকার বানান সিলেস। ৪ বল খেলে রানের খাতাই খুলতে পারেননি ফিজ।
৮১ রানে অষ্টম উইকেট পতনের পর জোসেফের করা ২৯তম ওভারেই তিনটি বাউন্ডারি আদায় করে নেন সাকিব। আর ৩২তম ওভারে সিলেসের বলটি মিড-অফ দিয়ে বাউন্ডারি মেরে টেস্ট ক্যারিয়ারের ২৮তম হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন সাকিব। ৬৪ বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নবম ও অধিনায়ক হিসেবে সপ্তম হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি।
হাফ-সেঞ্চুরি পাবার পরের ওভারেই থামেন সাকিব। জোসেফের করা ঐ ওভারের দ্বিতীয় বল থেকে ওভার বাউন্ডারি আদায় করতে চেয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু সীমানার কাছে দাঁড়িয়ে ক্যাচ নেন রোচ। ৬৭ বল খেলে ৮৮ মিনিট ক্রিজে থেকে ৫১ রান করেন সাকিব। ইনিংসে ৬টি চার ও ১টি ছক্কা মারেন তিনি।
সাকিবের বিদায়ের দুই বল পর বাংলাদেশের ইনিংসের শেষ উইকেট তুলে নেন জোসেফ। শূন্য হাতে খালেদ আহমেদের বিদায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দলীয় তৃতীয় সর্বনি¤œ ১০৩ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ৩ রানে অপরাজিত থাকেন এবাদত হোসেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেইডেন সিলেস-আলজারি জোসেফ ৩টি করে উইকেট নেন। এছাড়া কেমার রোচ-কাইল মায়ার্স ২টি করে শিকার করেন।
বাংলাদেশের ইনিংস শেষে ব্যাট হাতে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সামনে নিজেদের মেলে ধরতে পারছিলো না ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ওপেনার জন ক্যাম্পবেল ও ব্র্যাথওয়েট। প্রথম ১৫ ওভারে মাত্র ১৫ রান নিতে পারেন তারা। ২২তম ওভারে মিরাজকে ১টি করে চার-ছক্কা মারেন ক্যাম্পবেল।
অবশেষে ২৬তম ওভারে মুস্তাফিজের হাত ধরে প্রথমবারের মত উইকেট শিকারের আনন্দে মাতে বাংলাদেশ। ৭২ বলে ২৪ রান করা ক্যাম্পবেলকে বোল্ড করেন ফিজ। বল ক্যাম্পবেলের ব্যাট ছুঁয়ে ধীরে-ধীরে স্টাম্প স্পর্শ করে। ব্যাট দিয়ে বল সড়ানোর চেষ্টা করেও পারেননি ক্যাম্পবেল।
দলীয় ৪৪ রানে প্রথম উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্রুতই ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেট পতনের সংখ্যাটা বাড়তে পারতো। কিন্তু কঠিন ক্যাচকে তালুবন্দি করতে পারেননি বাংলাদেশ ফিল্ডার লিটন।
মুস্তাফিজের করা ২৮তম ওভারের চতুর্থ বলে রেইমন রেইফারকে ও পঞ্চম বলে ব্র্যাথওয়েটকে জীবন দেন লিটন। রেইফারকে প্রথম স্লিপে, আর লেগ-স্লিপে ব্রার্থওয়েটের ক্যাচ ফেলেন লিটন।
ব্যক্তিগত ৪ রানে জীবন পেয়ে ১১ রানেই থামেন রেইফার। বাংলাদেশের পেসার এবাদত হোসেনের এক দুর্দান্ত ডেলিভারি সামলাতে না পেরে উইকেটের পেছনে নুরুলকে ক্যাচ দেন রেইফার। ২৬ বলে ১১ রান করেন তিনি।
৭২ রানে ২ উইকেট হারানোর পর দিনের শেষভাগটা বিপদটা ছাড়াই পার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২ উইকেটে ৯৫ রান তুলে দিন শেষ করে তারা। ব্র্যাথওয়েট ১৪৯ বল খেলে ৪টি চারে অপরাজিত ৪২ ও বোনার ৪৩ বলে অপরাজিত ১২ রান করেন।
বাংলাদেশের মুস্তাফিজ ১০ রানে ও এবাদত ১৮ রানে ১টি করে উইকেট নেন।
স্কোর কার্ড : (টস-ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস :
তামিম ইকবাল ক ডা সিলভা ব জোসেফ ২৯
মাহমুদুল হাসান জয় ক বোনার ব রোচ ০
নাজমুল হোসেন শান্ত বোল্ড ব রোচ ০
মোমিনুল হক ক ব্লাকউড ব সিলেস ০
লিটন দাস ক ডা সিলভা ব মায়ার্স ১২
সাকিব আল হাসান ক রোচ ব জোসেফ ৫১
নুরুল হাসান এলবিডব্লু ব মায়ার্স ০
মিরাজ ক ডা সিলভা ব সিলেস ২
মুস্তাফিজুর ক ডা সিলভা ব সিলেস ২
এবাদত অপরাজিত ৩
খালেদ ক বোনার ব জোসেফ ০
অতিরিক্ত (বা-১, লে বা-৪, ও-১) ৬
মোট (অলআউট, ৩২.৫ ওভার) ১০৩
উইকেট পতন : ১/১ (জয়), ২/৩ (শান্ত), ৩/১৬ (মোমিনুল), ৪/৪১ (তামিম), ৫/৪১ (লিটন), ৬/৪৫ (নুরুল), ৭/৭৭ (মিরাজ), ৮/৮১ (মুস্তাফিজ), ৯/১০৩ (সাকিব), ১০/১০৩ (খালেদ)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলিং :
রোচ : ৮-২-২১-২ (ও-১),
সিলেস : ১০-২-৩৩-৩,
জোসেফ : ৮.৫-২-৩৩-৩,
মায়ার্স : ৫-২-১০-২,
মোতি : ১-০-১-০।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস :
ব্রার্থওয়েট অপরাজিত ৪২
ক্যাম্পবেল বোল্ড মুস্তাফিজ ২৪
রেইফার ক নুরুল ব এবাদত ১১
বোনার অপরাজিত ১২
অতিরিক্ত (লে বা-৪, নো-২) ৬
মোট (২ উইকেট, ৪৮ ওভার) ৯৫
উইকেট পতন : ১/৪৪ (ক্যাম্পবেল), ২/৭২ (রেইফার)।
বাংলাদেশ বোলিং :
মুস্তাফিজ : ১২-৬-১০-১,
খালেদ : ৯-৪-১৫-০,
এবাদত : ১২-৪-১৮-১ (নো-২),
সাকিব : ৮-২-২০-০,
মিরাজ : ৭-১-২৮-০।